(ক) তুলাতন্তুর (সুতি কাপড়ের) গুণাগুণ
সুতি কাপড়ের তত্ত্বগুলো আসে তুলা থেকে। অল্প দৈর্ঘ্যের তুলাতন্তু অপেক্ষা বেশি দৈর্ঘ্যের তুলা তন্তুর কাপড় বেশি সুন্দর ও টেকসই হয়। মোটা ও ছোট তন্তু হতে নিকৃষ্ট ও মোটা জাতীয় কাপড় তৈরি করা হয়। তুলাতন্তু দ্বারা তৈরি সুতি কাপড়ে সহজে ভাঁজ পড়ে, কম উজ্জ্বল হয়, তাপ সুপরিবাহী হয় এবং এর শোষণক্ষমতা ভালো হওয়ায় সব ঋতুতে ব্যবহার করা যায়। সুতিবস্ত্রের যত্ন নেওয়া সহজ। মাড় প্রয়োগ করা যায়। উজ্জ্বলতা বাড়ানোর জন্য সাদা বস্ত্রে নীল দেওয়া যেতে পারে এবং ইস্ত্রি করার সময় বেশি সাবধানতা অবলম্বন করতে হয় না।
সাবান, সোডা, গরম পানি ইত্যাদি দিয়ে ধোয়া যায়। ধোয়ার সময় ঘষা ও রগড়ানো যায়। তুলাতন্তুর মূল্য তুলনামূলকভাবে কম, তাই পোশাক ছাড়াও এই তন্তুর তৈরি বস্ত্র বিছানার চাদর, শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা, মশারি, লেপ, সোফার কাপড়, ন্যাপকিন, ঘর সাজানোর সামগ্রী ইত্যাদি কম ব্যয়বহুল হয়।
(খ) ফ্ল্যাক্সতন্তুর (লিনেন কাপড়ের) গুণাগুণ
লিনেন বস্ত্র উৎপাদন হয় ফ্ল্যাক্সতত্ত্ব থেকে। আর ফ্ল্যাক্সতন্তুর উৎপত্তি হচ্ছে তিসি বা মসিনা গাছ (Flax) থেকে। এর উজ্জ্বলতা রেশমের মতো নয়, তবে তুলার তুলনায় উজ্জ্বল হয়। তুলাতত্ত্ব অপেক্ষা দুই থেকে তিন গুণ বেশি শক্তিশালী, ভেজালে এ শক্তি আরও বৃদ্ধি পায়। পানি শোষণ ক্ষমতাও তুলার চেয়ে ভালো। তবে এরূপ বস্ত্রে সহজে ভাঁজ পড়ে।
ফ্ল্যাক্সতত্ত্ব দিয়ে সূক্ষ্ম সুতা ও মসৃণ লিনেন বস্ত্র তৈরি করা যায়, যা বেশ চকচকে, মজবুত ও ঠান্ডা। বিভিন্ন রং প্রয়োগ করে এদের সৌন্দর্য আরও বাড়ানো যায়। এরূপ বস্ত্র পরিধানে আরাম বোধ হয়। এই তন্তু সমতলভাবে অবস্থান করে এবং সুন্দরভাবে ঝুলে থাকে। তাই টেবিল কভার, বিছানার চাদর, রুমাল, পর্দা, পরিধেয় ও গৃহস্থালি বস্ত্র হিসেবেও এর জনপ্রিয়তা অনেক। পানি শোষণ ক্ষমতা অনেক বেশি থাকায় লিনেন বস্ত্র গরমের দিনের পোশাকের জন্য বেশ আরামদায়ক।
কাজ ১- সুতি ও লিনেন বস্ত্রের বৈশিষ্ট্যের তুলনা করো। |
(গ) রেশমতত্ত্বর গুণাগুণ- রেশম প্রাকৃতিক তন্তুর মধ্যে সবচেয়ে বড়, উজ্জ্বল ও মোলায়েম প্রাণিজ তন্তু। গুটি পোকার লালা থেকে এটা উৎপাদিত হয়। রেশমতত্ত্বর বস্ত্রে সহজে ভাঁজ পড়ে না। সূর্যালোকে রেশম দুর্বল হয়। অধিক তাপে সাদা রেশম হলুদ রং ধারণ করে। রেশম তত্ত্ব তাপের ভালো পরিবাহী নয়, তাই গ্রীষ্মকালে পরিধান করলে গরম বেশি লাগে। সাবান, সোডা ইত্যাদি ক্ষারীয় পদার্থে রেশম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরূপ বস্ত্রে শুষ্ক অবস্থায় সহজে তিলা বা ছোট ছোট দাগ পড়ে না। সহজে সংকুচিত হয় না। রং ধারণ ক্ষমতাও ভালো, তবে ঘামে এ তত্ত্বর বেশ ক্ষতি হয়। রেশমি বস্ত্র সুতি ও লিনেনের চেয়ে ওজনে হালকা। এর বহুমুখী ব্যবহার উপযোগিতার কারণে শার্ট, ব্লাউজ, ছেলে ও মেয়েদের পোশাক, সজ্জামূলক উপকরণের উপযোগী বত্র ইত্যাদি এ তত্ত্ব থেকে তৈরি করা হয়। রেশমি বস্ত্র দামি তবে যত্নসহকারে ব্যবহার করলে অনেকদিন স্থায়ী হয়।
(ঘ) পশমতত্ত্বর গুণাগুণ- পশম একটি প্রাণিজ তন্তু। বিভিন্ন প্রাণীর মধ্যে ভেড়ার লোমই পশমি বস্ত্রে বেশি ব্যবহার করা হয়। পশম তন্তুর পানি শোষণক্ষমতা সবচেয়ে ভালো। পশম তত্ত্ব বেশ নমনীয় ও স্থিতিস্থাপক। এজন্য সহজে ভাঁজ পড়ে না। পশম তাপের সুপরিবাহী নয়। তাই সোয়েটার, মোজা, মাফলার, কোট, প্যান্ট, জ্যাকেট ইত্যাদি পশমি বস্ত্র শীতবস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া পশম দিয়ে নানা ধরনের কম্বল, শাল, কার্পেট ইত্যাদিও তৈরি করা হয়। ভিজলে পশমি বস্ত্রের আকৃতি ও শক্তি কিছুটা কমে যায়। তাই ধোয়া ও ইস্ত্রি করার সময় বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। যত্নসহকারে ব্যবহার করলে অনেকদিন ব্যবহার করা যায় এবং টেকসই হয়।
কাজ ১- ক্লাসের শিক্ষার্থীদের নিয়ে কয়েকটি দল তৈরি করো। প্রত্যেক দল বিভিন্ন ধরনের বস্ত্রের টুকরা সংগ্রহ করে তত্ত্বর গুণাগুণ শ্রেণিকক্ষে উপস্থাপন করো এবং বিভিন্ন কাপড়ের বৈশিষ্ট্যের তুলনা করো। কাজ ২- প্রাত্যহিক জীবনে কোন তন্তু কী কাজে ব্যবহৃত হয় একটি ছকে তা উল্লেখ করো। |
অনেক তত্ত্ব আছে যা প্রাকৃতিকভাবে জন্মায় না। মানুষ প্রাকৃতিক তত্ত্বর সাথে রাসায়নিক দ্রব্য মিশিয়ে কিংবা শুধু রাসায়নিক দ্রব্য থেকে যেসব তত্ত্ব আবিষ্কার করে তাদেরকে কৃত্রিম তন্তু বলে। যেমন-নাইলন, রেয়ন, পলিয়েস্টার ইত্যাদি। এই পাঠে রেয়ন ও নাইলন তন্তুর গুণাগুণ নিয়ে আলোচনা করা হবে।
(ক) রেয়নতত্ত্বর গুণাগুণ- রেয়ন তন্তুর বস্ত্র রেশম তন্তুর মতো সুন্দর ও উজ্জ্বল। তাই একে কৃত্রিম রেশমও বলা হয়। রেয়নের স্থিতিস্থাপকতা রেশমের চেয়ে বেশি। রেয়ন তাপের সুপরিবাহক। রেয়ন উৎপাদনের মূল উপাদান বিশুদ্ধ সেলুলোজ। রেয়ন তত্ত্ব সাধারণত আলোর প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। ১৪৯০ সেলসিয়াসের অধিক তাপে পুড়ে যায়। পানিতে রেয়নতত্ত্ব সুতি অপেক্ষায় বেশি সংকুচিত হয়। মৃদু ক্ষারে এসব তন্তুর বিশেষ কোনো ক্ষতি হয় না। পরিষ্কার ও শুষ্ক অবস্থায় থাকলে এরা তিলা দিয়ে আক্রান্ত হয় না, তবে স্যাঁতসেঁতে অবস্থায় থাকলে তিলা পড়ে। এসব তন্তুর রং ধারণের ক্ষমতা ভালো। পানিতে ভেজালে দুর্বল হয়ে যায়, শুকালে আবার শক্তি ফিরে আসে।
অন্যান্য বস্ত্রের তুলনায় রেয়ন সস্তা। বিভিন্ন মূল্যের রেয়ন বস্ত্র বাজারে পাওয়া যায় বলে এরূপ বত্র সহজেই অনেকে কিনতে পারে। রেয়ন তত্ত্বর একটি গুণ হলো এর আকর্ষণীয় রূপ। বিভিন্ন প্রয়োজনে বিভিন্ন মাত্রার এরূপ উজ্জ্বল তন্তু বাজারে পাওয়া যায়। এছাড়া বহুমুখী ব্যবহারের জন্য এই তত্ত্ব বেশ জনপ্রিয়। এরূপ তন্তুর নির্মিত কার্পেট, বিছানার চাদর, গৃহসজ্জার সামগ্রী, পর্দা ইত্যাদি ঘরের নতুনত্ব আনয়ন করে। রেয়ন তন্তুর বত্র মজবুত, উজ্জ্বল ও দীর্ঘস্থায়ী হয়। এরূপ বসত্র সহজে ধোয়া ও যত্ন নেওয়া যায়।
(খ) নাইলনতস্তুর গুণাগুণ - কৃত্রিম তন্তু বলে এর দৈর্ঘ্য ও ব্যাস নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এ তন্তুর কিছুটা চাকচিক্য আছে। নাইলন তত্ত্ব ওজনে হালকা তবে বেশ মজবুত, নমনীয় এবং দীর্ঘস্থায়ী। পানিতে ভিজলে এর শক্তির কোনো পরিবর্তন হয় না। এই তত্তুর বসেত্র কোনো ভাঁজের দাগ পড়ে না। নাইলনের মধ্য দিয়ে বায়ু চলাচল করতে পারে না। এজন্য গরমের দিনের চেয়ে বর্ষা বা শীতের দিনে এর ব্যবহার বেশি দেখা যায়। নাইলন তন্তুর তাপ সহ্য করার ক্ষমতা কম। ১৮৯° সেলসিয়াস তাপমাত্রায় নাইলন তত্ত্ব গলে যায় এবং ধূসর বা তামাটে রঙের আঠালো ছাই অবশিষ্ট হিসেবে থাকে, যা বাতাসের সংস্পর্শে শক্ত হয়ে যায়। অধিক তাপে এই তত্ত্ব গলে যায়। তবে ধোয়ার সময় হালকা গরম পানি ব্যবহার করা চলে। সূর্যের আলোতে এ তত্ত্বর কোনো ক্ষতি হয় না। মৃদু ক্ষার এবং মৃদু এসিডেও কোনো ক্ষতি হয় না। তবে গাঢ় এসিডের সংস্পর্শে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্লোরিনের মতো উগ্র ব্লিচিং পদার্থ নাইলন বস্ত্রে ব্যবহার করতে নেই।
এই তত্ত্ব মথ, ছত্রাক প্রভৃতি দিয়ে আক্রান্ত হয় না। পানি শোষণ ক্ষমতা এ তন্তুর কম। রঙের প্রতি আসক্তিও কম। রং প্রয়োগে বিশেষ পদ্ধতির প্রয়োজন হয়।
নাইলনের বস্ত্র মজবুত ও ওজনে হালকা হওয়ায় এর বহুমুখী ব্যবহার দেখা যায়। টেকসই ও স্থিতিস্থাপক বলে অন্তর্বাস, মশারি, বিছানার চাদর, আসবাবপত্রের ঢাকনা, ছাতার কাপড়, ফিতা, চুলের নেট, লেস, সুতা, মাছ ধরার জাল, চামড়ার সামগ্রীর আস্তরণ, কার্পেট, গলফ খেলার ব্যাগ ইত্যাদি তৈরিতে নাইলনের সুতা ও বস্ত্র ব্যবহৃত হয়।
নাইলনের বত্র সহজেই ধোয়া ও শুকানো যায়, এজন্য বর্ষার দিন বেশি ব্যবহার করা হয়। নাইলনের তত্ত্ব অন্যান্য তন্তুর সমন্বয়ে নানা ধরনের গুণসম্পন্ন বস্ত্র তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। যেমন নাইলন সুতি, নাইলন পশম, নাইলন রেয়ন ইত্যাদি। ময়লার প্রতি আকর্ষণ কম বলে সহজে ময়লা ধরে না। ইত্রি করারও বেশি দরকার হয় না।
কাজ ১- নিচের ছকের বাম দিকের কলামে কৃত্রিম তন্তুর নাম দেওয়া আছে। প্রত্যেকের বিপরীতে ডান দিকের কলামগুলোতে উক্ত শ্রেণির তত্ত্বর গুণাগুণ ও ব্যবহার সম্পর্কে লিখবে। |
বিভিন্ন শ্রেণির তত্ত্ব | তন্তুর গুণাগুণ | তন্তুর ব্যবহার |
রেয়নতত্ত্ব | ||
নাইলনতত্ত্ব |
বহুনির্বাচনি প্রশ্ন :
১. নিচের কোনটি তৈরিতে নাইলনতত্ত্ব ব্যবহার করা হয়?
ক. পর্দা
খ. রুমাল
গ. টেবিল কভার
ঘ. ছাতার কাপড়
২. কোন তন্তুর তৈরি পোশাকে রঙের বৈচিত্র্য কম দেখা যায়?
ক. লিনেন
খ. রেশম
গ. রেয়ন
ঘ. নাইলন
নিচের উদ্দীপকটি মনোযোগ দিয়ে পড়ো এবং ৩ ও ৪ নং প্রশ্নের উত্তর দাও:
ফারহানা তার প্রাকৃতিক তন্তুর তৈরি সাদা রঙের দামি শাড়িটিকে ধুয়ে কড়া রোদে শুকাতে দিয়ে অফিসে চলে যান। বিকেলে বাসায় এসে শাড়িটি ঘরে আনার পর তিনি দেখতে পান কাপড়টির উজ্জ্বলতা কমে গেছে ও হলুদ রং ধারণ করছে।
৩. ফারহানার শাড়িটি কোন তন্তুর তৈরি?
ক. সুতি
খ. রেশম
গ. লিনেন
ঘ. রেয়ন
৪. ফারহানার শাড়িটির যথাযথ বা উপযুক্ত যত্নের জন্য প্রয়োজন-
i. ধোয়ার কাজে সাবান বা সোডা ব্যবহার না করা
ii. ছায়ায় শুকাতে দেওয়া
iii. মৃদু তাপে ইস্ত্রি করা
নিচের কোনটি সঠিক?
ক. i ও ii
খ. i ও iii
গ. ii ও iii
ঘ. i, ii ও iii
সৃজনশীল প্রশ্ন :
১. সায়েরা গ্রীষ্মের দুপুরে ছেলে ইরফানকে সুতির শার্ট প্যান্ট ও মেয়ে সাবাকে রেশমের জামা পরিয়ে বিয়ের অনুষ্ঠানে নিয়ে যান। মা খেয়াল করেন বিয়েবাড়ির অতিরিক্ত লোকজনের ভিড়ে তার ছেলেটি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করলেও মেয়ে সাবা কিছুটা অস্বস্তিতে ভুগছে। বাসায় ফেরার পর মা ইরফান ও সাবার পরিহিত কাপড়গুলোকে একসাথে গরম পানিতে ভিজিয়ে সাবান দিয়ে ঘষে ধুয়ে দেন।
ক. ফ্ল্যাক্স-এর উৎস কোনটি?
খ. সব ঋতুতে সুতি বস্ত্রের ব্যবহার আরামদায়ক কেন? বুঝিয়ে লেখো।
গ. সাবার অস্বস্তিতে ভোগার কারণ ব্যাখ্যা করো।
ঘ. কাপড় ধোয়ার ক্ষেত্রে সায়েরার প্রক্রিয়ার যথার্থতা বিশ্লেষণ করো।